Monday, October 5, 2015

সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে আমার অনাস্থা ও অবিশ্বাসের নানা কারণ

।।মাহবুব মোর্শেদ।।
একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে সাহিত্য পুরস্কার চালু করার চিন্তাভাবনা চলছে। উদ্যোগটি নিচ্ছেন সেখানকার একজন কর্তাব্যক্তি। পুরস্কারের টাকার জন্য তিনি একটা ব্যাংকের শরণাপন্ন হবেন। প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে গেছে। প্রোপোজাল বানানোর কাজ চলছে। কী মনে করে যেন, ওই ব্যক্তি আমার পরামর্শ চাইলেন।
আমি বললাম, একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করার সুযোগ আছে কি না। যদি থাকে তাহলে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যেভাবে পুরস্কার দেওয়া হয় সেভাবে পুরস্কার দেবার কথা চিন্তা করতে পারেন।
কী রকম?

আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরস্কারের জন্য লেখক বা প্রকাশকের কাছ থেকে বই জমা চাওয়া হয়। বাইরেও এমন ঘটে। প্রকাশকরা বই পাঠান বটে, লেখকরাও পাঠান কিন্তু বেশিরভাগ পুরস্কার দেওয়া হয় পুরস্কার কমিটির খাটাখাটনির ফল হিসেবে। পুরস্কার কমিটি এবছর প্রকাশিত বইগুলোর মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ একটা তালিকা সংগ্রহ করে। সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে রিভিউয়ের ভিত্তিতে সেগুলো থেকে বেশ কিছু বই বাছাই করে। একটা বাছাই কমিটি বইগুলো পড়ে পর্যালোচনা করে একটা লম্বা তালিকা করে। পুরস্কার দেবার জন্য যে কমিটি নির্বাচন করা হয় তারা লম্বা তালিকা থেকে একটা ছোট তালিকা করে। এক্ষেত্রে পাঠকের মতামতও নেওয়া হয়। পরে জুরিরা একটা বই বেছে নেন।
ধরা যাক, আপনি এ বছরের সেরা বইটিকে পুরস্কৃত করতে চান। বই মেলার সময় আপনার একটা টীম কাজ করবে। তারা প্রকাশিত সব বইয়ের তালিকা সংগ্রহ করবে। সেখান থেকে যাচাই বাছাই করে ৫০০ বই কিনে নিয়ে আসবে। কেনার মতো ৫০০ বই তারা পাবে না। ৩০০ বই হয়তো পাবে। সেখান থেকে আপনি ১০০ বই বাছবেন। এই একশত বই পড়া হবে। উদ্যমী লোকদের একটা টীম বইগুলো পড়ে মতামত জানাবে। সে মতামতের ভিত্তিতে ৫০টা বইয়ের রিভিউ আপনার পত্রিকায় ছাপা হবে। এইটাই লম্বা তালিকা। একটা বিচারক মণ্ডলী এই তালিকা থেকে ১০টা বই বাছাই করবে। জুরি বোর্ড ১০ টা থেকে ১টা বই বাছাই করবে।
আমার প্রস্তাব শুনে উনি বললেন, এটা কী সম্ভব? এত খাটাখাটনি কে করবে।
যাই হোক, পরদিন উনি আমাকে বললেন, আপনার প্রস্তাবটা ভাল। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা একটা লাইব্রেরি করবো। লেখক-প্রকাশকদের কাছ থেকে বই আহবান করলে অতিদ্রুত আমাদের লাইব্রেরি ভরে উঠবে।
২. তো যে ব্যাংককে প্রস্তাবটা ওনারা পাঠালেন সে ব্যাংকটি বললো, কোনো এক্সপেরিমেন্ট আমরা চাই না। এটা আমাদের পিআর। আমরা আপনাদের পুরস্কারের টাকা, অনুষ্ঠানের টাকা, বিচারকদের সম্মানি ইত্যাদি বাবদ ১০ লাখ টাকা দেব। এই দশ লাখ টাকার পিআর সাপোর্ট আমরা চাই। ফলে, আপনারা এমন লেখকদের পুরস্কার দেবেন যাদের নামটা সবাই জানে। আমরা যাতে তাদের ইমেজটা সেল করতে পারি। সবচেয়ে ভাল হয় যদি লেখকটি অন্য পুরস্কারও পায়। বইয়ের দিকে অতো নজর না দিলেও হবে। আমাদের ফিগার দরকার।
৩. আমি তখন আরেক পত্রিকায় কাজ করি। পত্রিকাটি মাস খানেক আগে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, গত বছরের সেরা বই নির্বাচন করা হবে। অতএব বই পাঠান। লেখক-প্রকাশকরা ৫ কপি করে বই পাঠাতে শুরু করেছেন। পুরস্কার কমিটির মূল কর্তার ঘর বইয়ে বইয়ে সয়লাব। ঘর ভরে যায়, আর উনি পিয়নদের দিয়ে সেগুলো গোডাউনে পাঠান। লক্ষ্য করে দেখলাম, প্যাকেটগুলো খোলা হচ্ছে না। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, কত বই জমা হলো?
উনি বললেন, এবার গুরুত্বপূর্ণ কী বই বের হয়েছে আপনি জানেন না?
জানি।
আমিও জানি। আর প্যাকেট খোলার দরকার আছে। আমাদের অজান্তে কেউ সাহিত্যে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে এমন কি হতে পারে?
আমার টার্গেট ৫টা বই। ৫টা বই আমি বই মেলার সময় বাছাই করেছি। পড়াও শেষ। এখন বিচারক মণ্ডলী পড়বে। তারা যে বইটা বেছে নেয়।
তারা কি সিনসিয়ারলি পড়ে?
কই আর পড়ে।
গতবার অধ্যাপক অমুককে বই পাঠালাম। সময় শেষ দিকে। ফোন দিলাম রেজাল্টের জন্য। বলে, বইগুলার সিনোপসিস করে পাঠাও। তাও পাঠালাম। বলে, একটা লোক পাঠাও পড়ে শোনাক। আমি শুনেই নাম্বার দিয়ে দেব।
৪.
এরকম ঘটনা আমিও জানি। আমি একবার অধ্যাপক তমুকের বাসায় গেছি অন্য একটা কাজে। একথা সে কথার পর অধ্যাপক তমুক বললেন, আচ্ছা এখনকার তরুণদের লেখা নিয়ে বলো তো। আমি বলতে গেলে উনি বললেন, সাদেক মাদেক আর মোছলেম এই তিনজনের মধ্যে কে ভাল। এইরকম প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। এই নামগুলো উনি কই পেলেন।
তখন উনি ঝেড়ে কাশলেন।
বললেন, একটা নামী পুরস্কারের জুরি বোর্ডে উনি আছেন। তো কালকেই নাম্বার জমা দিতে হবে।
আমি বললাম, আগাইছেন কিছু।
উনি বলেন, সময়ই করতে পারলাম না। এখন বলো, শেষ বেলায় কোনো খারাপ বইকে বেশি নাম্বার দিয়ে ফেললে কেমন হবে?
৫.
একটা সাহিত্য পুরস্কারের মধুচক্রীর সাথে তখন আমার খুব ভাব। তো এইবার ওনার খুব ইচ্ছা ওনার অত্যন্ত প্রীতিভাজন একজন ব্যক্তিকে পুরস্কার দেবেন। উনি ৫ জন বিচারক ঠিক করছেন। ধরা যাক তাদের নাম, যদু, মধু, সিধু, বিধু আর দিনু। ৫ জনকে ৫টা বই এক কপি করে পাঠানো হয়েছে। সিনোপসিসও পাঠানো শেষ। যাকে উনি পুরস্কার দেবেন তার সিনোপসিস বেশ ভাল করে তৈরি করা হয়েছে। বাকীগুলো যাচ্ছে তাই। তারপরও মধুচক্রী নিশ্চিত হতে পারছেন না। তো শেষ বেলায় উনি ফোনে কথা বলছেন। ওই কমিটিতি মধু বাবু বাঘা লোক। তো উনি ফোনে মধুদার রেফারেন্স ব্যবহার করে বলছেন, যদু বিধু, সিধু আর দিনুকে আলাদা আলাদা করে। আপনার কারটা ভাল লাগলো? মধুদা তো দেখলাম পিউকাহাকে বেশ এগিয়ে রেখেছেন। রেজাল্ট যখন এলো, তখন দেখা গেল পিউকাহাই এগিয়ে। কেউ আবার মধুচক্রীর কথায় দ্বিমত করলে পরের বার জুরি বোর্ডেই রাখবে না। লেখাও ছাপবে না। কালো তালিকায় নাম উঠে যাবে।
৬.
একবার এক ভদ্রলোক আমাকে পুরস্কার দেবেন বলে ভাবছেন। কাজটা ঠিক হবে কি না, উনি নিশ্চিত না। নানাজনের সাথে পরামর্শ করছেন। একদিন আমাকেও ফোন দিলেন। বলে, মাহবুব তুমি তো আসো না, বসো না, থাকো না, খাও না।
আমি বললাম, কেন কী হইছে?
বলেন, এইভাবে কি হয়? একটা পুরস্কার চালু করলাম। লোকজন কত তদবির করে করে নিতেছে। অথচ তুমি এত কাছের লোক হাই-হেলোটাও করো না।
আমি বললাম, এত লোক থাকতে আমি কেন? আমার কাছে আপনার কী স্বার্থ?
উনি বলে, সবখানে স্বার্থ দেখলে চলে?
আমি বললাম, না রে ভাই। আমি একটা পুরস্কার নিয়া যে পাপ করছি। সেই পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাই না।
৭.
একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হচ্ছে। তো এক প্রবীণ লেখক পুরস্কারের পাণ্ডাকে ডেকে বলছেন, কী হে। আমাকে যখন দিলে তখন তো ৫০ হাজার ছিল। এখন তো বেশ ২ লাখ দিচ্ছে।
পাশ থেকে পুরস্কারের অর্থদাতা শুনে ফেললেন।
পরে শুনেছিলাম, পাণ্ডাটি পরে প্রবীণ লেখকের বাসায় আরও ৫০ হাজার টাকার একটি খাম পৌঁছে দিয়েছিলেন।
৮.
দৈনিক মনোরঞ্জন যে পুরস্কারটা দেয় সেটা পাবার খুব শখ লেখক তোফাজ্জল হোসেনের। উনি এর আগে দুটি বাগিয়েছেন। কিন্তু, মনোরঞ্জন না পেলে আর হচ্ছে না। মনোরঞ্জন বাবদ বেশ কয়েক গ্যালন মদ ইত্যাদি খরচা হয়ে গেছে। কিন্তু মধুচক্রী টপ ফাইভে রাখার বেশি কিছু আর বলছে না। উনি বললেন, তাহলে আমাকে বিচারকদের তালিকা দেন। দেয়া হলো। উনি বিচারকদের ম্যানেজ করে ঠিক মাল বের করে আনলেন। পুরস্কার পেলেন, তিন বছরের চেষ্টায়।

৯.
আমি তখন যে পত্রিকায় কাজ করি সেই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক বললেন, বই জমা দাও। আমি বললাম, ভাই মনটা খচখচ করে। এইটা ঠিক হবে না। আমি বই বের করার জন্য প্রকাশকের কাছে যাবো। আমি যত যুক্তি দেখাই উনি ততোই চেপে ধরে।
শেষে বলে, তুমি কি ভয় পাইতেছো? নিজের প্রতি তোমার বিশ্বাস নাই? তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি, নিরপেক্ষ বিচার হবে। তুমি পাইলে পাবা না পাইলে নাই।
শেষে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন বেতন পেতাম সামান্য। পুরস্কার পেলে দেবে ২৫ হাজার। বইও বের করবে। ভাবলাম, একটা কম্পিউটার কিনবো আর বই বের করার জন্য কাউরে ধর্ণা দিতেও হইলো না। তাছাড়া আমি তো আর আগ বাড়ায়ে কোনো তদবির করতেছি না। ওরাই বলতেছে।
বই জমা দিলাম। গল্পগুলা অগোছালো অবস্থায় ছিল। সবই প্রকাশিত। লোকজন পড়ছেও। গল্পকার হিসেবে ততোদিনে কিছু পসার হয়েছে।
একসময় নাম্বার আসা শুরু করলো।
পাণ্ডুলিপি থেকে নাম মুছে দিয়ে কোড দিয়ে নাকি বিচারকদের কাছে বই পাঠানো হইছে।
শেষে দেখা গেল পুরস্কার আমিই পাইছি।
জানাজানি হওয়ার পর একজন প্রশ্ন তুললেন, একই হাউসে কাজ করে সেই হাউসের পুরস্কার কীভাবে নেওয়া সম্ভব?
খুবই ন্যায্য প্রশ্ন। আমি খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম।
কিছুদিন পর আমি অন্য হাউসে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু, ওই খচখচানিটা আমার মন থেকে সরে যায়নি।
পুরস্কার যেদিন দেওয়া হলো, সেদিন তিনজন বিচারক এসে আমাকে বলেছিলেন, তারা বিচারক ছিলেন এবং তারা গল্পগুলা পড়ে বুঝতে পারছিলেন সেগুলো আমার গল্প।
পুরস্কারের টাকা দিয়ে আমি একটা কম্পিউটার কিনেছিলাম। কিন্তু খচখচানিটা যায়নি। ফলে, আমি পুরস্কার দাতাদের অনুরোধ করেছিলাম, বইয়ে যেন পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাটা না লেখা থাকে। কিন্তু তারা সেটা শোনেননি। এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে ঘটতে সেটা তলানিতে এসে ঠেকে।

No comments:

Post a Comment