Monday, October 5, 2015

উৎপলের হাত ধরে, উৎপলের হাত ছেড়ে

।।মাহবুব মোর্শেদ।।
উৎপলকুমার বসুকে নিয়ে লিখিতভাবে কোনো আলোচনা করা মুশকিল। কারণ বাংলাদেশে উৎপলকে নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো কথা, কোথাও না কোথাও কবিদের মধ্যে কবিতার পাঠকদের মধ্যে হচ্ছে। আর এই কথাবার্তা সবসময় সুখকর নয়। সুখকর কেন নয়, সেটা স্পষ্ট করার আগে বাংলাদেশের কবিতার গৃহদাহের একটা স্মৃতি উসকে না দিলেই নয়। এর নাম দেওয়া যায়, বাংলাদেশের কবিতার পরকীয়া ও তদ্জনিত পরিণতি। লোকে যেভাবে পরস্ত্রীর প্রেমে পড়ে অনেকটা সেভাবেই পশ্চিম বাংলার কবিদের প্রেমে পড়েছিলেন বাংলাদেশের আশি-নব্বইয়ের কবিরা। পরের কবিরাও যে সেই পথ অনুসরণ করেছেন, সেটা বিশেষভাবে না বললেও চলে।
এই পরকীয়া এক অর্থে পুনর্মিলনও। সাতচল্লিশ সালে প্রথম দফা স্বাধীনতা লাভের আগে পরে পূর্ববাংলার কবিরা যে স্বতন্ত্র স্বর নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন তার সবটা সফল হয়নি। কলকাতার নবজাগরণ, আলোকায়ন ও আধুনিকতার কাছে যেতে যেতে এবং এগুলো থেকে দূরে সরতে সরতে অনেক চেষ্টাই হয়েছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এসে তো মনেও হয়েছিল কলকাতা ও বাংলাদেশের কবিতা কোথাও কোথাও অনেকটা আলাদা হয়ে গিয়েছে। ভেতরে না হলেও বাইরের দিকটা আলাদাভাবেই চেনা যেত। সত্তরে এসে অবশ্য বাংলাদেশের কবিতার চেষ্টাগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আর এই সুযোগে আশির শক্তিশালী ধারাটা ফেরত গিয়েছিল কলকাতার অলটারনেটিভের কাছে। মূলত উৎপলের কাছে। বাংলাদেশের কবিতা বাইরের উচ্চস্বরের বদলে কেন ওই সময়টাতেই একটা স্থিরতা, চিন্তা, শৈলী ও বিন্যাসের দিকে ঝুঁকেছিল সেটা নিয়ে হয়তো আরও পরে কেউ ভাবতে পারবেন। কিন্তু তখন থেকেই তরুণ কবিরা বিনয়-শঙ্খ-শক্তি-উৎপল, জয় নিয়ে প্রচুর কথা বলা শুরু করেছেন। এর তেমন কোনো রিটেন ডকুমেন্ট নেই। প্রবন্ধ নেই।
কিন্তু কবিতা আছে, নিদর্শন হিসেবে।
শঙ্খ-শক্তি নিয়ে খুব বেশি আগানো যায়নি। তাদের কবিতা বোধহয়, অনুসরণের উর্ধ্বে। জয়ও কি? বিনয় তো মীথ। কিন্তু কবিতায় বিনয় মজুমদার ডেড এন্ড। কিন্তু উৎপল থাকলেন। কতটা থাকলেন, কতটা বাদ পড়লেন সেটা নিশ্চয়ই কেউ মেপে বলবেন। উৎপল বড় কবি না ছোট কবি সেটাও নিশ্চয়ই কেউ মাপবেন। কিন্তু বাংলাদেশের কবিতা আজ যেখানে সেখানে উৎপলকে ছাড়া কবিতার কোনো আলোচনাই শুরু বা শেষ হবার নয়। কেউ হয়তো পার্সোনালি ভাস্কর, রণজিৎ, মৃদুল দিয়ে প্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু ওসব ট্রেন্ড হিসেবে দাঁড়ায়নি।
উৎপল ট্রেন্ড শুধু না কাল্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। এই পরস্ত্রীর প্রেমে সবাই পড়েছেন। এ নিয়ে মুখে অনেক কথাই আছে। কবিতায় দাগও প্রচুর। কিন্তু লিখিত পড়িত কিছু নেই। লোকে বলে, ওই যে উনি কবিতায় যে ট্রেন্ডটা আনলেন সেটা তো উৎপলের ক্রাফট ধার করে। বলে, ও তো এখনও উৎপলের হাত ধরে আছে। বলে, তোর কবিতায় তো উৎপলই উঁকি দিচ্ছে। অথবা ভিন্নটা হয়েছে, উৎপল থেকে দূরে সরতে গিয়ে কারো কবিতা হয়তো খুব উদ্ভট হয়ে গেল। বোঝা গেল উনি প্রেমে যে পড়বেন না সেই চেষ্টাটাই করছেন। আশি-নব্বইয়ে আমরা যে বড় কবিদের পেয়েছি বাংলাদেশে তাদের অধিকাংশেরই এই হাল। তাই এখানে উৎপল নিয়ে কথা বলা বিপদ। প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করবে না এই প্রেমের খবর। করবে কি? দু একজন ব্যতিক্রম তো আছেনই।
উৎপল বাংলা কবিতার আগের বিন্যাসটাকে বসিয়ে দিয়ে নতুনভাবে সাজিয়েছেন। তার আগে এই ক্রাফট, এই সিনট্যাক্স, এই বোল, এই তাল কোথায় ছিল বাংলা কবিতায়? এত চিন্তামগ্ন, এত আত্মস্থ, এত এলোমেলো, এত সাজানো। তরুণ কবিরা যে উৎপলকেই মানবেন তাতে বিস্ময়ের কী আছে?
স্পষ্ট করে বললে, জীবনানন্দের পর এত প্রভাব আর কে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন?
মুশকিল হলো, উৎপলের কবিতা নিয়ে এত খোলাসা করে আলোচনা চলে না। বরং কবিতা পড়া গেলে ভাল।
ব্যক্তিগতভাবে আমাদের বন্ধুদের মতো আমাকেও প্রচণ্ড তাড়িত করেছেন উৎপল। তবে আমি অতো কবি নই। ফিকশনের দিকেই আমার ঝোঁক। ফলে, ফিকশনে আমি উৎপলের অনেক প্রভাব এনেছি। আমার ফেস বাই ফেস উপন্যাসটিতে যারা চোখ বুলিয়েছেন তারা জানবেন, ওখানে আমি উৎপলের অসংখ্য লাইন সরাসরি বা একটু পরিবর্তন করে বসিয়েছি। শুধু ক্রেডিট দিয়ে এতটা নেয়া যায় না।
প্রথম বইয়ের নাম ঠিক করবো যখন মনে হলো এই লাইনটা- ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত বসন্তদিন নামটাই রেখেছিলাম। এটাও তো উৎপলেরই।
হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উৎপলের লাইন মাথায় আসে। পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে যায়। এইভাবে মনে মনে আর কোন কবিকে এতটা আমরা উদ্ধৃত করতে পারি? এগুলো খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। অতো বলাবলির কিছু নেই।
বাংলাদেশের কবিতায় উৎপলকুমার বসু একটা অবসকিওর কাল্ট হিসেবেই হয়তো থাকবেন শেষ পর্যন্ত।

No comments:

Post a Comment